Special

গাজায় ১৩ হাজার নিখোঁজ ফিলিস্তিনির ভাগ্যে কী ঘটেছে?

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের আগ্রাসনে হতাহতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। সবশেষ তথ্য মতে, নিহতের সংখ্যা ৩৬ হাজার ছুঁইছুঁই। আহত ছাড়িয়েছে ৮০ হাজার।

ফিলিস্তিনের গাজার ধ্বংসাবশেষের নিচে ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির লাশ চাপে পড়ে আছে। ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

৬ মিনিটে পড়ুন

হতাহতের এই বিশাল সংখ্যার পাশাপাশি ১৩ হাজারের বেশি মানুষের কোনো সন্ধান নেই, এক রকম নিখোঁজ তারা। এদের অনেকে হয়তো এখনও ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে আছে। কিন্তু অনেক মানবাধিকার সংস্থা বলছে, বাকি অনেকেই সম্ভবত গুমের শিকার হয়েছেন।

এমনই একজন মুস্তাফা। আহমেদ আবু ডিউক তার ভাই মুস্তাফাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন গত কয়েক মাস ধরে। ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে শরণার্থী হওয়া আহমেদ আবুর পরিবার খান ইউনিসের দক্ষিণে নাসের হাসপাতালের সামনের উঠানে আশ্রয় নেয়।

কিন্তু একদিন তারা জানতে পারেন যে কাছেই তাদের ঘর আগুনে পুড়ে গেছে, তখন সেটার অবস্থা জানতে সেখানে যান মুস্তাফা। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। সেদিন থেকেই তিনি নিখোঁজ। আহমেদ আবু বলছিলেন, ‘আমরা যতটা পারি খুঁজেছি’।

একসময় যেখানে মুস্তাফাদের বাড়ি ছিল সেটা এখন পুড়ে যাওয়া এক ধ্বংসস্তুপ। আহমেদ বলেন, 

আশেপাশের সব বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং অনেক উঁচু উচুঁ ভবন মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।

পেশায় অ্যাম্বুলেন্স চালক মুস্তাফার খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকে তার পরিবার। হামাস নিয়ন্ত্রিত উদ্ধারকারী সংস্থা সিভিল ডিফেন্স-এর সদস্যরা মুস্তাফাদের বাড়ির ধ্বংসস্তুপের নিচে এবং নিকটস্থ গণকবরগুলোতে অনেক লাশ উদ্ধার করেছে। কিন্তু মুস্তাফার দেখা পাওয়া যায়নি।

তবে তার পরিবার এখনও আশায় বুক বেঁধে আছে। আহমেদ বলেন, 

আমাদের এখনেও আশা, হাসপাতালে প্রতিনিয়ত যেসব অ্যাম্বুলেন্স আসছে-যাচ্ছে তার কোনো একটাতে আমরা তাকে খুঁজে পাব।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরাইলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। কিন্তু সংখ্যাটা শুধুমাত্র হাসপাতাল থেকে যে সংখ্যা জানা গেছে তার ওপর ভিত্তি করে। মুস্তাফাদের মতো এমন আরও অনেক পরিবার আছে যারা আসলে জানে না গত সাত মাসে নিখোঁজ হওয়া তাদের প্রিয়জনেরা কোথায় আছে, কেমন আছে।

জেনেভাভিত্তিক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের মতে, ইসরাইলের আগ্রাসনে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি ১৩ হাজারের ওপর ফিলিস্তিনি নিখোঁজ হয়েছে। তাদের কোনো সন্ধান নেই। এই পরিসংখ্যানে কতজন হামাস যোদ্ধা ও কতজন সাধারণ নাগরিক আছে তা আলাদা করার সুযোগ নেই।

গত সাত মাসের বেশি সময় ধরে ইসরাইলের চালানো নির্বিচারে হাজার হাজার টন বোমাবর্ষণে গাজায় ৮০ ভাগ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। গাজার সিভিল ডিফেন্সের হিসেবে ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি শুধু এসব ধ্বংস হওয়া ভবন ও স্থাপনার নিচে চাপা পড়ে আছে।

জাতিসংঘ এক হিসেবে জানিয়েছে, গাজা উপত্যকাজুড়ে যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছে তার পরিমাণ হবে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ টন। আর এর নিচে যেভাবে মানুষের লাশ চাপা পড়ে আছে তেমনি প্রায় সাড়ে ৭ হাজার টন অবিস্ফোরিত বোমা আছে, যা স্বেচ্ছাসেবক ও ত্রাণকর্মীদের জন্য আরেকটা ভয়াবহ হুমকি।

গাজার সিভিল ডিফেন্স বলছে, তারা তাদের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে চাপা পড়া লাশ উদ্ধারে কাজ করছেন। কিন্তু তাদের কাছে যা কিছু যন্ত্রপাতি আছে, তা খুবই সাধারণ ও নিম্নমানের। এসন যন্ত্রপাতি দিয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে লাশের কাছে পৌঁছানোটা কঠিন।

এছাড়া আরেকটা শঙ্কাও আছে। সেটা হলো লাশ যদি না ঢেকে ধ্বংসাবশেষের নিচে এভাবেই পচাঁ অবস্থায় থেকে যায়, তাহলে সামনে গরম যখন আরও বাড়বে তখন এই অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে।

গাজার আবদুর রহমান ইয়াঘির অনেক আত্মীয়-স্বজনের লাশ এভাবে ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে আছে। চাপা পড়া সেসব লাশ বের করতে গিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তিনি।

মধ্য গাজার দেইর আল বালাহ শহরে আবদুর রহমানের পরিবারের একটি তিনতলা বাড়ি ছিল। বড় পরিবারের ৩৬ জন সদস্য সেই বাড়িতে বাস করতেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ওই বাড়ির ওপর ইসরাইলি মিসাইল আঘাত হানে। সে সময় ছোট ছোট শিশুসহ পরিবারের ৩৬ জন সদস্যই বাড়িতে ছিলেন। তারা সবাই ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়েন।

আবদুর রহমান জানান, ৩৬ জনের মধ্যে মাত্র ১৭টি উদ্ধার করা গেছে। এছাড়া শরীরের ছিন্নভিন্ন কিছু অংশ পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলো কার শরীরের অংশ তা শনাক্ত করা যায়নি। তিনি বলেন, 

আমরা বাড়িতে থাকা বেশিরভাগ শিশুর লাশ খুঁজে পাইনি।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশ যাদের উদ্ধার কাজে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী কর্মী আছে তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছে গাজার সিভিল ডিফেন্স। তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছেও আবেদন করেছে।

অন্যদিকে ইসরাইলের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে, যাতে তারা গাজায় উদ্ধারকাজের জন্য ভারি যন্ত্রাপাতি আসার অনুমতি দেয়। কিন্তু তাদের সেই আবেদনে এখনও কোন সাড়া মিলেনি।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বাস, যাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাদেরকে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) তাদের পরিবারকে অন্ধকারে রেখে আটক করে থাকতে পারে। ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের হিসেবে, আইডিএফ পরিবারদের না জানিয়েই গাজার শত শত ফিলিস্তিনকে আটক করেছে।

কিন্তু জেনেভা কনভেনশন, যেটাতে ইসরাইলও স্বাক্ষর করেছে, সেখানে বলা আছে, একটা দেশ যদি কোন বেসামরিক নাগরিককে আটক করে রাখে তাহলে তার পরিচয় ও তাকে কোথায় রাখা হয়েছে সেটা জানাতে হবে।

কিন্তু ইসরাইল সেটা তো করেইনি, বরং গত ৭ই অক্টোবরের হামলার পর থেকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাদের আটককেন্দ্রগুলোতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির পরিদর্শন বাতিল করেছে।

গাজায় রেডক্রসে কর্মরত হিশাম মুহানা বলেন, 

আমরা বারবার ফিলিস্তিনিদের যেখানে ধরে রাখা হয় সেখানে প্রবেশাধিকার চেয়েছি। কিন্তু আমাদের সেই অনুমতি এখনও দেয়া হয়নি।

আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি জানায় ইসরাইলি বন্দিদের রাখা হামাসের আটককেন্দ্রেও তারা যাওয়ার অনুমতি পায়নি। এ ব্যাপারে আইডিএফের কাছে মন্তব্য জানতে চাইলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে ইসরাইলের উগ্রপন্থী নেতা ও জাতীয় নিরপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির লিখেছেন, ‘ইসরাইলে বন্দি করে রাখা হামাস যোদ্ধাদের ব্যাপারে রেডক্রসকে কিছুই জানতে দেয়া হবে না, যতক্ষণ না তারা ইসরাইলকে আমাদের যেসব নাগরিকদে বন্দি করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্য না জানাতে পারবে। মানবিকতার বিনিময়েই কেবল মানবিকতা।’

মধ্য গাজার আরেকটা শহর আল জুয়াইদাতে আরেকটা পরিবার তাদের হারানো সন্তানের সন্ধান করে চলেছে। তাদের ভয়, তাদের সন্তানকেও হয়তো গুম করা হয়েছে। মোহাম্মদ আলীর মা তার সন্তানের একটা ছবি হাতে নিয়ে অনেকদিন খুঁজেছেন। কিন্তু একদিন তিনি জানতে পারেন, তার ছেলেকে আইডিএফ ধরে নিয়ে গেছে। এরপর খোঁজাখুঁজিও বন্ধ করে দেন।

গত ২৩ ডিসেম্বর যখন উত্তর গাজার জাবালিয়ায় মারাত্মক বোমাবর্ষণ শুরু হয়, তখন এই পরিবারটি আশ্রয়ের খোঁজে নিজ বাসা ছেড়ে একটা স্কুলে এসে ওঠে। আর সেদিন থেকেই মোহাম্মদের কোন খোঁজ নেই।

মোহাম্মদের স্ত্রী আমানি আলী বলেন, একপর্যায়ে ইসরাইলি সেনারা স্কুলেও ঢুকে পড়ে এবং নারী ও শিশুদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। তিনি বলেন, এরপর সেই রাতে সব পুরুষরা তাদের পরিবারের কাছে ফেরত আসলেও মোহাম্মদ আর আসেননি।

মোহাম্মদ আলী কোথায় আছেন, কেমন আছেন কিছুই তার পরিবার আর জানে না। স্ত্রী আমানি বলছিলেন, তিনি বুঝতে পারছেন না যে তার স্বামী কি মারা গেছেন নাকি তাকে আইডিএফ ধরে গেছে। আর একারণেই বেঁচে থাকার একটা ক্ষীণ আশা এখনও রয়ে গেছে তার।আমানির বিশ্বাস, 

যদি তিনি বেঁচে থাকতেন ও মুক্ত থাকতেন তাহলে তিনি ঠিকই আমাদের খুঁজে বের করতেন।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এমন পরিবারগুলোর জন্য একটা অনলাইন ফর্ম তৈরি করেছে। সেখানে মৃত ও নিখোঁজদের ব্যাপারে জানা যায় এবং যাতে করে ৭ই অক্টোবর থেকে যারা নিখোঁজ তাদের ব্যাপারে একটা পরিপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা যায়।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, ডন ও আল জাজিরা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button